আকাশের গাড়ি

আকাশের গাড়ি

পড়তে সময় লাগবে: 4 মিনিট...

ল্যাম্প পোষ্টের নিচে পড়াশুনা করে ভালো ফলাফল করা আজ যেন পুরনো এক অর্জনের নাম। নতুন অর্জন নিয়ে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে আকাশ আহমেদ। চলুন তবে একটু খুলেই বলি।

যারা বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ডের গাড়ির খবর নিয়মিত রাখেন, তারা নিশ্চই ল্যাম্বরগিনির নাম শুনে থাকবেন। ইতালিয়ান এই অটোমোবাইল ব্র্যান্ডের গাড়ি দেখতে যেমন নজরকাড়া তেমনি স্টাইলিশ। বিখ্যাত সব সেলিব্রেটি এবং ধনীদের পছন্দের তালিকায় সবার উপরেই থাকে এই গাড়ি। দামও নেহায়েত কম না। একটা ল্যাম্বরগিনি কিনতে গেলে খরচ করতে হয় কোটি টাকার উপরে। এত দামী গাড়ি নিয়ে সাধারণ মানুষ স্বপ্ন দেখতেই পারেন। কিন্তু বাস্তবে নিজের একটা ল্যাম্বরগিনির মালিক হওয়া যেনতেন কাজ নয়। কিন্তু কেমন হবে যদি অল্প দামেই একটা ব্যক্তিগত ল্যাম্বরগিনি পাওয়া যায়? তাও আবার আমাদের বাংলাদেশেই! অনেকের কাছে কাল্পনিক মনে হলেও, কল্পনাকেই সত্যি করেছেন বাংলাদেশের তরুণ আকাশ আহমেদ। নিজের অটোরিকশা গ্যারেজেই তিনি বানিয়েছেন তার স্বপ্নের ল্যাম্বরগিনি।

বেশিদূর পড়াশোনা করেননি, শিখেছেন গাড়ির কাজ

নারায়ণগঞ্জের লামাপাড়ার নবী হোসেনের ছেলে আকাশ আহমেদ। ক্লাস ফোর পর্যন্ত স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। এরপর নবম শ্রেণী পর্যন্ত ছিলেন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। এরপর আর পড়াশোনায় এগুতে পারেননি তিনি। তার বাবা নবী হোসেনের একটি অটোরিকশা গ্যারেজ/ওয়ার্কশপ আছে। ছোটকাল থেকে এই ওয়ার্কশপেই খেলতে খেলতে বড় হয়েছেন আকাশ। ওয়ার্কশপের গাড়ি মেরামতের নানান যন্ত্রপাতিই ছিল তার খেলনার উপকরণ। আর চোখে ছিল স্বপ্ন- একদিন নিজেই একটা গাড়ি বানাবেন।

স্বপ্ন যাত্রা

তার ল্যাম্বরগিনি বানাবার স্বপ্নের শুরু ২০১৩ সালে। জনপ্রিয় গণমাধ্যম বিবিসির সাথে একটি সাক্ষাৎকারে, আকাশ আহমেদ জানান, ইমরান খানের স্যাটিসফায়া গানে একটা ল্যাম্বরগিনি গাড়ি দেখে তাতে তার চোখ লেগে গিয়েছিল। আর সেদিন থেকেই তিনি সংকল্প করেছিলেন একদিন নিজের হাতে এই মডেলের গাড়ি বানাবেন। পড়াশোনা ছেড়ে বাবার গ্যারেজে অটোরিকশা মেকানিকের কাজই শিখতেন তিনি। আর নিজের স্বপ্নকে লালন করতেন। তিনি আরো বলেন,

রাস্তায় নতুন মডেলের স্টাইলিশ গাড়ি দেখলে বুকের মধ্যে কেমন একটা মোচড় দিয়ে উঠতো। মনে হতো যদি আমারো এমন একটা গাড়ি থাকতো! বাবাকে এইসব বলতে ভয় পেতাম। কারণ এত দামী গাড়ি কেনার সামর্থ্য আমার বা আমার পরিবারের কখনো ছিল না। তাই একদন সাহস করে বাবাকে জানিয়ে দিলাম আমি একটা গাড়ি বানাতে চাই”

২০১৮ সালের দিকে তার বাবাকে তার স্বপ্নের কথা জানান। তার বাবাও তাকে গাড়ি বানাবার অনুমতি দেন। তারপর থেকে শুরু হয় তার স্বপ্ন পূরণের যাত্রা।

স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপ

অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া যেকোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই তিনি শুরু করলেন ল্যাম্বরগিনি গাড়ির ডিজাইন। গাড়ির ডিজাইন করতে তিনি তার গ্যারেজের ক্যালেন্ডারে থাকা ল্যাম্বরগিনির ছবির সাহায্য নিয়েছেন। গাড়িটির প্রায় সম্পূর্ণ অংশই তার ডিজাইন করা। স্পাতের পাত কেটে কেটে তার গাড়ির বডি বানিয়েছেন তিনি। গাড়ি বানাতে এর পাশাপাশি তিনি সাহায্য নিয়েছেন ইউটিউব টিউটোরিয়ালের। কম খরচে নিজের জন্য ল্যাম্বরগিনি তৈরিই তার প্রধান লক্ষ্য। অটোরিকশা ওয়ার্কশপের হাতে কলমে কাজ শিখেছেন। তাই তার স্বপ্ন এবং অভিজ্ঞতার মিশ্রণে তিনি যে গাড়িটি বানিয়েছেন তাতে ব্যবহার করা হয়েছে ইজিবাইকের ব্যাটারি। নিজেই বানিয়েছেন গিয়ার, ব্যাকলাইট, হেডলাইট, সাসপেনশন। শুধুমাত্র ব্যাটারি, গাড়ির ইস্টিয়ারিং এবং চাকাগুলো কিনে আনা হয়েছে। গাড়িটি বানাতে আকাশের সময় লেগেছে প্রায় ১৪ মাস। সম্প্রতি ঈদ উল ফিতরের ছুটিতে তিনি তার তৈরি করা ল্যাম্বরগিনি প্রথমবারের মতো রাস্তায় বের করেন। প্রথমে তো এলাকাবাসী বিশ্বাসই করতে পারেনি এই গাড়ি তিনি বানিয়েছেন!

কি আছে আকাশের বানানো ল্যাম্বরগিনিতে

প্রথমত আকাশের তৈরি গাড়িটি সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব! যেহেতু এট ইলেকট্রিক গাড়ির মতই ব্যাটারিতে চলে তাই কোন কালো ধোঁয়া উৎপন্ন হয় না। ইঞ্জিনের কোন শব্দ হয়না। ফলে শব্দ দূষণও হবেনা এই গাড়ির কারণে। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে বানানো এই গাড়িটির গতি ঘণ্টায় ৪৫ কি.মি. বেগে চলতে পারে। আমাদের দেশে শহুরে রাস্তায় সাধারণত এই বেগেই গাড়ি চলে। ফলে কম খরচে শহরের মানুষ এই গাড়িটি অনায়াসেই ব্যবহার করতে পারবেন। গাড়িতে ইজিবাইকের মোট ৫ টি ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়েছে। যা সম্পূর্ণ চার্জ হতে সময় নেয় ৫ ঘন্টা এবং একবার চার্জ দিলে গাড়িটি ১০ ঘন্টা চলতে সক্ষম। গাড়িতে গান শোনার জন্য সাউন্ড সিস্টেমও রেখেছেন তিনি।

বন্ধুর পথ ও স্বপ্নজয়

গাড়িটি বানাতে আকাশকে অনেক বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। যেহেতু একবারে বিনিয়োগ করার মতো পর্যাপ্ত আর্থিক সামর্থ্য তার ছিল না, তাই বাবার দেয়া পকেট খরচ জমিয়েই তিনি অল্প অল্পকরে এই গাড়িটি তৈরি করেন। এছাড়া গাড়ি নিয়ে তার প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান না থাকায় অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। অনেকেই প্রথমে তাকে বিশ্বাস করতে পারেনি। কিন্তু মানুষের নেতিবাচক চিন্তাকে পাশ কাটিয়ে তিনি তার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেছেন। প্রচুর ইউটিউব টিউটোরিয়াল দেখে দেখে অল্প অল্প করে গাড়ি মডিফিকেশন শিখেছেন। কোন কাজে একবার ভুল হলে কাজটি আবার নতুন করে শুরু করতে হতো তাকে। কিন্তু লক্ষ্য পূরণে তিনি কখনো থেমে থাকেন নি। তবে তার পারিবার তার সাথে ছিলো সবসময়। অবশেষে স্বপ্ন যখন সত্যি হয়ে ধরা দিলো, তারপর তিনিই বনে গেলেন টক অফ দ্যা টাউন!

আকাশের এমন অভাবনীয় সাফল্য দেখে, নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক রাব্বি মিয়া আকাশকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এমনকি সস্ত্রীক আকাশের ল্যাম্বারগিনিতে চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন আদালত পাড়ায়। সেদিন আকাশের গাড়ি দেখার জন্য উৎসুক জনতা ভিড় জমিয়েছিলেন সেখানে। এছাড়াই জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং মিডিয়া কর্মীরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

দাম এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

মিনি ল্যাম্বারগিনি স্পোর্টস কারটি বানাতে আকাশের খরচ হয়েছে তিন লাখ টাকা। তবে বাণিজ্যিক ভাবে গাড়ি বানানোর অনুমতি পেলে এই দাম আরো কমে যাবে বলে আশা করেন তিনি। শুধু নিজের জন্য গাড়ি না বানিয়ে দেশের মানুষের জন্যও গাড়ি বানাতে চান তিনি। ইতোমধ্যে ২৫ টি গাড়ির অর্ডার পেয়েছেন কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে গাড়ি বানানোর অনুমতি দরকার তার। তাই তিনি সরকারের কাছে বাণিজ্যিক ভাবে গাড়ি বানানোর অনুমতি চেয়েছেন তিনি। তিনি তার বানানো গাড়ির নকশা কারো কাছে বিক্রি করতে চান না। পরবর্তীতে ল্যাম্বারগিনি ছাড়াও অন্য ব্রান্ডের আদলেও গাড়ি বানাতে চান চিনি। কিন্তু এই পরিকল্পনার কথা এখনি পুরোপুরি খোলাসা করতে চান না।

কথায় বলে, ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’। ল্যাম্বরগিনি বানিয়ে এই কথাকেই কাজে প্রমাণ করলেন আমাদের দেশের তরুণ যুবক আকাশ আহমেদ।

 71 total views,  1 views today

Share your vote!


Related Posts

To Buy Prohori

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

© 2024