“যদি দাগ থেকে দারুণ কিছু হয়, তবে দাগই ভালো’- মনে পরে মনকে নাড়া দেওয়া সেই বিজ্ঞাপনের কথা। জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই সেই কথাটা ঠিক। এমনকি বিজ্ঞানের মত কাটখোট্টা বিষয়ের জন্যও। পৃথিবী এবং মানব জাতিকে বদলে দেওয়া বিজ্ঞানের এমন অনেক আবিষ্কার হয়েছে যা ছিল বিজ্ঞানীদের ভুলে কিংবা একান্তই মনের অজান্তে। উল্টা করে বলা যায় এগুলি যদি আবিষ্কার না হত তবে মানব সভ্যতার ইতিহাস অন্যরকম ভাবে ধরা দিত। এই রকম ভুল হাজার বার হোক। আজ এই রকম বেশ কিছু যুগান্তকারী ভুল তুলে ধরবার চেষ্টা করব।
মাইক্রোওয়েভ ওভেনঃ
বিজ্ঞানী শব্দটা কানে আসলেই মাথায় ভেসে আসে চরম মেধাবী কিন্তু আত্মভোলা এক মানুষের ইমেজ। যারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা গবেষণাগারে কাজ করে। নিজের খাবার কথাও ভুলে যায়। ভাগ্যিস পার্সি স্পেনসার নামের এক আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার গবেষণাগারে খাওয়া দাওয়া করতেন। পার্সি ম্যাগনেট্রন নামে একটি ভ্যাকুয়াম টিউব নিয়ে কাজ করছিলেন, যেটি থেকে মাইক্রোওয়েভ নির্গত হয়। এটির সামনে দাঁড়িয়ে উনি কি যেন ভাবছিলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন তার প্যান্টের পকেটে রাখা চকলেটের বার গলতে শুরু করেছে! প্রচণ্ড মেধাবী বিজ্ঞানী স্পেনসারের বুঝতে বাকি রইল না যে বিশাল এক আবিষ্কার তিনি করে ফেলেছেন। তারপর চলল নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষা। অবশেষে ১৯৪৫ সালে মাইক্রোওয়েভ ওভেন আলোর মুখ দেখল তাঁর হাত ধরেই। যদিও প্রথমদিকে দেখতে সেটা ঢাউস একটি জিনিস ছিল। ১৯৬৭ সাল থেকে আমেরিকার ঘরে ঘরে বাণিজ্যিক ভাবে উৎপাদিত মাইক্রোওয়েভ ওভেন ব্যাবহার শুরু হয়েছিল।
ধন্যবাদ পার্সি স্পেনসার এর পাশাপাশি পকেটে রাখা নিরীহ চকলেট টারও পাওনা।
পেনিসিলিনঃ
পেনিসিলিন আবিষ্কার করেছিলেন আলেকজান্ডার ফ্লেমিং, যিনি ছিলেন একজন চিকিৎসক এবং জীবাণুতত্ত্ববিদ। তবে মজার ব্যাপার হল পেনিসিলিন তিনি সচেতন ভাবে আবিষ্কার করেন নি। বরং ফ্লেমিং যখন পেনিসিলিন আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পান, উনি কৌতুক করে বলেছিলেন ‘এ পুরষ্কারটি ঈশ্বরের পাওয়া উচিত, কারণ তিনিই সবকিছুর আকস্মিক যোগাযোগ ঘটিয়েছেন।’
১৯২৮ সালে ফ্লেমিং স্টেফাইলোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণা করছিলেন লন্ডনের এক ল্যাবরেটরিতে। গবেষণাকে স্থগিত রেখে দু সপ্তাহের জন্য বেড়াতে যান স্কটল্যান্ডে। যাবার সময় তিনি স্টেফাইলোকক্কাসটি একটি কাঁচের পাত্রে রেখে যান এবং একটি ভুল করেন- গবেষণাগারের জানালা খুলে রেখে যান!দু’সপ্তাহ ছুটি কাটিয়ে গবেষণাগারে ফিরে তিনি আবিষ্কার করেন, কোন ফাঁকে ঝড়ো বাতাসের দমকে খোলা জানালা দিয়ে ল্যাবরেটরির বাগান থেকে কিছু ঘাস পাতা উড়ে এসে পড়েছে জীবাণু ভর্তি প্লেটের উপর। তিনি প্লেটগুলোতে দেখলেন জীবাণুর কালচারের মধ্যে স্পষ্ট পরিবর্তন। চতুর বিজ্ঞানীর বুঝতে একটুও দেরি হল না যে আগাছাগুলোর মধ্যে এমন কিছু আছে যার জন্য পরিবর্তন ঘটেছে। তিনি গবেষণা করে দেখলেন আগাছাগুলোর উপর একরকম ছত্রাক জন্ম নিয়েছে। সেই ছত্রাকগুলো বেছে বেছে জীবাণুর উপর দিতেই জীবাণুগুলো ধ্বংস হয়ে গেল! ছত্রাকগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম ছিল পেনিসিলিয়াম নোটেটাম, তাই তিনি এর নাম দিলেন পেনিসিলিন।
একবার ভাবুন তো ফ্লেমিং যদি ভুল না করে জানাল বন্ধ করে জেতেন, আমরা কি হারাতাম???
এক্স–রেঃ
ঘটনাটি “ক্যাথোড রে” আবিষ্কারের অনেক পরের। ১৮৯৫ সালে জার্মান পদার্থবিদ উইলহেম রঞ্জন একটি কালো কাগজে ঢাকা গ্লাস টিউবে ক্যাথোড রশ্মি চালিয়ে পরীক্ষা করছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল খুব সাধারণ- কাঁচ থেকে ক্যাথোড রে বের হয় কিনা সেটি পরীক্ষা করা। কিন্তু বিজ্ঞানী অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন তাঁর কিছু দূরে একরকম আলোক রশ্মি দেখা যাচ্ছে। তিনি ভাবলেন হয়তো কার্ডবোর্ড ফেটে এই ঘটনা ঘটছে। কিন্তু না, দেখা গেল কার্ডবোর্ড ফেটে নয় বরং কার্ডবোর্ড ভেদ করে রশ্মি বের হচ্ছে! বিজ্ঞানী ভাবলেন – যে রশ্মি কার্ডবোর্ড ভেদ করতে পারছে তা মানবদেহ কেন ভেদ করতে পারবে না? তিনি তার স্ত্রীর হাত সামনে রেখে পরীক্ষা চালালেন। বলুন তো তিনি কি দেখতে পেলেন? ঠিকই ধরেছেন, ইতিহাস বদলে দেওয়া একটা ঘটনা ঘটলো । – প্রথমবারের মতো কাটাছেঁড়া না করেই মানবদেহের কঙ্কালের ফটোগ্রাফিক ইমেজ তৈরি সম্ভব হলো! তাঁর স্ত্রীর কংকালের ছবি দেখে তিনি পরবর্তীতে ব্যাখ্যা করেন “আমি যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুকে দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে!” যাই হোক, অদৃশ্য এই রশ্মির বৈশিষ্ট্য অজানা থাকায় রঞ্জন এর নাম দেন এক্স-রে।
ডায়নামাইটঃ
আলফ্রেড নোবেলকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার কিছু নেই। নোবেল পুরষ্কারের প্রবক্তা হিসেবে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন ইতিহাসে। তিনি ডায়নামাইট আবিষ্কার করেছিলেন। তবে এই আবিষ্কারের পথটা ছিল বন্ধুর। রাসায়নিক বিভিন্ন পদার্থ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নোবেল এবং তার ল্যাবরেটরির মানুষজন বেশ কয়েকবার ভয়াবহ সব দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাঁর ভাই ১৮৬৪ সালে সুইডেনের স্টকহোমে এমনই এক দুর্ঘটনায় মারাও যায়। ভাইয়ের মৃত্যুর শোঁক কে শক্তিতে রুপান্তর করে আলফ্রেড নোবেল উঠে পরে লাগেন। লক্ষ্য তাঁর একটাইঃ নিরাপদভাবে বিস্ফোরণ ঘটানো।
মারাত্মক বিস্ফোরক নাইট্রোগ্লিসারিনকে প্রশমিত করার উপায় নোবেল খুঁজে পান একটি দুর্ঘটনার মাধ্যমে! একবার নাইট্রোগ্লিসারিন ভর্তি একটি পাত্র ছিদ্র হবার পরেও তিনি দেখতে পান কোন এক জাদুবলে তা কোন বিপদ ঘটাচ্ছে না। পরে তিনি বুঝতে পারেন এই জাদু আসলে কিয়েসেলগার নামে এক ধরনের পাললিক শিলার কারসাজি যা দিয়ে পাত্রটি মোড়ানো ছিল। সেই কিয়েসেলগার নাইটড়োগ্লিসারিনকে খুব ভালোভাবে শোষণ করেছে। তার মানে হল নোবেল এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পেরেছেন যে নাইট্রোগ্লিসারিন যেহেতু তরল অবস্থায় খুব বিপদজনক, কিয়েসেলগারকে বিস্ফোরকের স্ট্যাবিলাইজার হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। ১৮৬৭ সালে নোবেল একই সাথে নিরাপদ এবং ভয়াবহ রকমের শক্তিশালী এই বিস্ফোরকটি ‘ডিনামাইট’ নামে পেটেন্ট করান।
কলমঃ
হাত বারালেই কলম পাওয়া যায়। কিন্তু একবার কি ভেবে দেখেছি কিভাবে কলম এত সহজলভ্য হল? প্রথম কলম আবিষ্কারের পেটেন্ট নেন রোমানিয়ার পেত্রাশ পোনারু। সেটা ১৮২৭ সালের কথা। প্রচুর নোট নেবার তাগিদ তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াতো। তাঁর এই তাড়না থেকেই তিনি আবিষ্কার করেন ফাউন্টেন পেন। তবে জন লাউড নামের একজন মার্কিনীকে বলপয়েন্ট আবিষ্কারকের সম্মান দেওয়া যেতে পারে। তিনি অবশ্য তাঁর চামড়ার ব্যবসার জন্য চামড়ার ওপর লেখার বলপেন আবিষ্কার করেন। তাঁর এই কলম দিয়ে কাগজের উপরে লেখা যেত না। এর প্রায় ৫০ বছর পর হাঙ্গেরির একজন সাংবাদিক তরল কালির পরিবর্তে কলমে ছাপাখানার শুকনো কালি ভরে দেন। কলমের নিবের মাথায় বসিয়ে দেন ছোট একটি ঘুরন্ত বল। এভাবেই আমরা পেয়ে গেলাম সহজে লেখার জন্য আধুনিক বলপয়েন্ট পেন।
চুম্বকঃ
ধারনা করা হয় ম্যাগনেট সর্বপ্রথম আবিস্কার হয় আজ থেকে প্রায় ৪,০০০ বছর আগে। আবিষ্কারক ছিলেন ম্যাগনাস নামের এক ভেড়াপালক। একদিন তার জুতোতে থাকা লোহার আংটা ম্যাগনেটিক পাথরের সাথে আটকে যায়। সেই পাথরের পরে নামকরন হয় ম্যাগনেটাইট।
ক্লোরোফর্মঃ
বর্তমান সময়ে অস্ত্রপ্রচার টেবিলে যে উপকরণটি অতীব জরুরি হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেটি হলো ক্লোরোফর্ম। এই ক্লোরোফর্ম আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে মজার কিছু গল্প। আসুন জেনে নেওয়া যাক ক্লোরোফর্ম তৈরির পেছনের মজার গল্প।ক্লোরোফর্ম আবিষ্কার করেছেন স্যার জেমস ইয়াং সিম্পসন, এই বিখ্যাত বিজ্ঞানি জন্ম গ্রহন করেন ৭ জুন ১৮১১ সনে, স্কটল্যান্ডে। এই বিখ্যাত বিজ্ঞানি অনেক দিন ধরেই চেতনানাশক নিয়ে গবেষনা করছিলেন। একদিন তার বাড়িতে তার কিছু বন্ধু বেড়াতে আসেন। এই সময়ে তিনি তার গবেষণার কাজ অনেকটা এগিয়ে নিয়েছেন। তিনি যেটা আবিষ্কার করেছেন তা বন্ধুদের দেখাতে কৌতহলি হয়ে উঠেন। যেই কথা সেই কাজ, তিনি একটা বোতলে করে সামান্য পরিমাণ ক্লোরোফর্ম তাদের নাকের সামনে ধরেন। এতটুকুই তারা মনে করতে পারেন, প্রত্যেকে চেতনা হারিয়ে ফেলেন।বিজ্ঞানি খুব ভয় পেয়ে যান, কিন্তু সকালবেলা তাদের প্রত্যেকের ঘুম ভাঙে। এটা দেখে বিজ্ঞানির আর কিছু বুঝতে বাকি থাকে না!
১৮৩১ সনে তিনি এটা সর্ব প্রথম আবিষ্কার করেন কিন্তু তখনো এটা মানুষের উপর ব্যবহার শুরু হয় নি। কারণ ক্লোরোফর্ম এর কিছু পার্শপতিক্রিয়া রয়েছে, অধিক মাত্রায় ব্যবহার করা হলে এটা কিডনি ও লিভারের স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে। তাই আবিষ্কারের পর এটা প্রয়োগের মাত্রাবিধি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষনার পরে ১৮৪২ সালে প্রাণীর উপর সর্বপ্রথম প্রয়োগ করা হয়। এর পর মাত্র তিন বছর পর ১৮৪৭ সালে এটা মানুষের উপর প্রয়োগ করা হয়। যা আজও রোগী অজ্ঞানের কাজে ব্যবহার হয়ে আসছে।
60 total views, 1 views today